।। বাক্‌ ১১৮ ।। অনুপম মুখোপাধ্যায় ।।






পন্যাসের জন্ম থেকে তার জীবনকাল কেটেছে মানুষের প্রতি অন্য মানুষের আগ্রহকে সম্বল করে। মানুষ জানতে চায় অন্য মানুষের জীবন সম্পর্কে, এবং, অন্য মানুষের জীবনের ঘটনাগুলো সম্পর্কে। উপন্যাস তখন প্রাসঙ্গিক ছিল, যখন ১০০ মিটার দূরে গেলেই একজন মানুষ আরেকজনের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত, তার গলা আবছা হয়ে যেত, সে কে সেটা আর স্পষ্ট দেখা যেত না, হাওয়ায় কুয়াশা থাক বা না থাক। সেই সময় মানুষ জানতে চেয়েছে একটা নির্জন দ্বীপে আটকা পড়লে একজন নিঃসঙ্গ শ্বেতাঙ্গ মানুষ কী ভাবে দিন কাটাতে পারে, ফলে লেখা হয়েছে ‘রবিনসন ক্রুশো’। জানতে চেয়েছে একজন কুৎসিত কুঁজো লোক যদি কোনো রূপসীর প্রেমে পড়ে তাহলে কী হবে, ফলে লেখা হয়েছে ‘হাঞ্চব্যাক অব নতরদাম’। আমাদের এখানেও টেকচাঁদ ঠাকুর বা বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের স্বপ্নময় চক্রবর্তী অবধি, সকলেই অন্য মানুষের প্রতি, অন্যরকম জীবনের প্রতি, আশ্চর্য ও চিত্তাকর্ষক ঘটনার প্রতি, মানুষের কৌতূহলকে রসদ করেছেন, খুবই শিল্পসম্মতভাবে, শ্রম ও আকাঙ্ক্ষা দিয়ে গড়েছেন সেই কৌতূহল এবং তার নিরসনের আদল। গল্প-উপন্যাসের এই হল গোড়ার কথা- তা সে আরব্য উপন্যাস হোক, ঠাকুরমার ঝুলি হোক, অথবা পাওলো কোহেলো বা হারুকি মুরাকামির কোনো ভুবনবিজয়ী উপন্যাস।
       কিন্তু, আজ এই ২০১৭-র পৃথিবীতে, এমনকি আমাদের বাঙালি সমাজেও, সেই কৌতূহল আজ আর মূল্যবান নয়। সে আজ মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। তাকে অপদস্থ করেছে ডেইলি সিরিয়াল। যে কারণে বাঙালি একদা উপন্যাস পড়ত, আজ সেই একই কারণে সে সিরিয়াল দেখে- অন্যের বাড়িতে এবং জীবনে উঁকি দিয়ে দেখার নিষিদ্ধ আনন্দ। যে উপন্যাস-লেখক বাঙালিকে সেই পুলক দ্যাননি, যেমন জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, বাঙালি জনসাধারণ সেই লেখকদের পাত্তা দ্যায়নি। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুলে নিয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর বনফুলকে, তাও নেহাত তখন ডেইলি সিরিয়াল ছিল না বলেইসিরিয়াস লেখকরা এখানে শুধুই লেখকদের লেখক। তাঁদের জাত আছে, কিন্তু বিক্রি নেই। বিক্রি আছে সিরিয়াল লেখকদের। বিক্রি = সামাজিক চাহিদা।
       আজ এই ডেইলি সিরিয়ালের যুগে একজন সিরিয়াস সাহিত্যিকের গল্প বলায় অরুচি আসতে বাধ্য। কেন তিনি গল্প বলবেন? এই প্রশ্ন ক্যামেরা আবিষ্কৃত হওয়ার পরে সেই শিল্পীর মুখেও আমরা শুনতে পেয়ে থাকব- ‘কেন আর আমি অবিকল ছবি আঁকব? আমি কি লেন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব?’ প্রতি মুহূর্তে বাঙালি এখন গল্প পাচ্ছে- নিউজ চ্যানেলে গল্প, খবরের কাগজে গল্প, হারিয়ে যাওয়ার গল্প, ধর্ষণের গল্প, দলবদলের গল্প, ফাঁসি হয়ে যাওয়া নিরপরাধের গল্প, বেমালুম ঘুরে বেড়ানো অপরাধীর গল্পনিউজ চ্যানেলের চেয়ে ভালো গল্প আজ কে বলতে পারে? ইন্টারনেটের চেয়ে? নিউজ পোর্টালের চেয়ে? কেউ পারবেন না।
       আজ একজন দীক্ষিত সাহিত্যিক গল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবেন না। তিনি গল্পকে ধ্বংস করবেন। ভাষার সেই স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, যেখানে গল্প নিশ্চিহ্ন হয়ে স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। গল্প সেখানে মায়ামৃগ হয়ে আছেতার লাবণ্য ও আর্তনাদ সহ। যে ফুল কানন করত আলো, কালো হয়ে সে শুকাল।


অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক


চিত্রঋণ  Vladimir Kush