।। বাক্‌ ১১৮ ।। রিপন হালদার ।।





দরজা





-‘স্যার! আমি অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাই!’
-‘অদ্ভুত শব্দ! মানে, কী রকম?’  
-‘এই ধরুন- প্রথমে গম গম ধরনের। তারপর টুং, টিল, ভোম, ঘোং, ক্লিং, টল্‌ - প্রভৃতি  বিচিত্র ধরনের শব্দ। কিছুটা গিটার বা পিয়ানোর শব্দের কাছাকাছি। কিন্তু আবার পুরোপুরি ওরকমও না’
-‘হুম্‌ তা কখন শুনতে পান?’ বিস্ময়ের ভাব গোপন করে ডাক্তার জানতে চান।
-‘শুধু যখন চোখ বুজে থাকি। ভোর বেলা যেমন ধীরে ধীরে আলো এসে চারদিক ফর্সা করে দেয়, অনেকটা সেই রকম। অথচ চোখ খুললে ভ্যানিশ! আবার যখন চোখ বুজি ধীরে ধীরে পোষা বিড়ালের  মত ওরা এসে হাজির হয়ে যায়। তারপর আমি এক খেলা শুরু করি। একবার চোখ বন্ধ করি, শব্দ শুরু। চোখ খুললে শব্দ বন্ধ। এইভাবে অনেকটা কারেন্টের সুইচের মত অন অফ, অন অফ করতে থাকি’
-‘বাহ্‌! ব্যাপারটা তাহলে বেশ এনজয় করছেন!’ মৃদু হাসি ডাক্তারের চোখে মুখে।
-‘কিছুটা’ 
 বলে রোগী মনেহয় কিছুটা লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে থাকে। তারপর ডাক্তারই আবার জানতে চান।
-‘এই শব্দ কি চাইলে যেকোন সময়ই শুনতে পান?’
-‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা এখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে মনেহচ্ছে। সেদিন রেল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে দিয়ে ঝম্‌ ঝম্‌ করে গড়িয়ে চলেছে ট্রেন। কী মনে করে যেন আমি চোখ দুটো বন্ধ করলাম। ব্যাস্‌ ট্রেনের বিকট শব্দ মুছে গিয়ে কীসব হাবিজাবি শব্দ শুনতে পেলাম। এবং তা আগের থেকে উচু ভলিউমে। যখন চোখ খুললাম দেখি ট্রেন চলে গেছে আর কোন শব্দও নেই কানে। আমি এখন কী করব, স্যার?’
বছর সতেরোর ছেলেটির চোখে মুখে চূড়ান্ত অসহায়তা।
-‘দেখুন, আপনার কথা শুনে আর কান দেখে আমার মনে হল যান্ত্রিক ভাবে কানে আপনার কোন সমস্যা নেই’  
-‘তাহলে?’  
-‘আমার মনেহয় সমস্যাটা আপনার মনে। আই মিন, মানে, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কী বলতে চাইছি!’
-‘তার মানে... আমি কি পাগল হয়ে যাব, স্যার?’
-‘না না। একদম তা নয়। মনের অসুখ মানেই কিন্তু পাগল হওয়া নয়’
-‘তাহলে?’
-‘হয়ত সামান্য কোন কারণ, মাইনার কোন স্নায়ুবিক ফল্ট, আপনার এই ডিজ-অর্ডারের জন্য দায়ি। দু-একটা সিটিং-এ ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা’
এই পর্যন্ত বলে ডাক্তার আরো জানতে চান।
-‘আচ্ছা, আরেকটা কথা। আপনি কি ঘুমের মধ্যেও ঐ শব্দগুলো শুনতে পান?’
-‘যতক্ষণ ঘুম না আসে, চোখ বন্ধ থাকলে শুনতে পাই। নাহ্‌ ঘুমের মধ্যে কোন শব্দ শুনতে পাই না’
-‘ভালো কথা। আপনি ঠিক কবে থেকে, আই মিন কোন ঘটনা থেকে বুঝলেন যে চোখ বুঝলে শব্দ আসে?’
-‘এক্সাক্টলি বলতে পারব না। তবে মাস কয়েক আগে, বা ছ মাস, না না এক বছরও হতে পারে। একদিন মা বলল বাবা নাকি আর দিল্লি থেকে ফিরবে না। আমি জানতে চাইলাম কেন? কোন উত্তর নেই। মা শুধু কাঁদে। শেষ পর্যন্ত মা আমাকে মামা বাড়ি রেখে কলকাতা গেল কাজ করতে। কী কাজ জানিনা। মা শুধু বলল মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। প্রতি রবিবার মা এসে আমাকে দেখে যাবে’
-‘হুম্‌ তারপর?’
-‘প্রায় তিন মাস হতে চলল মাও নিরুদ্দেশ। কোন খবর নেই। মোবাইল অফ। প্রতি রবিবার সকালে টিউশন পড়তে না গিয়ে আমি রেল স্টেশনে বসে থাকি। কত মানুষ আসে যায়, মা আর আসেনা। এক রবিবার সারাটা দিন বসে ছিলাম। পিকনিকে যাবার নাম করে। সন্ধ্যাবেলা গুণে দেখলাম আমি একচল্লিশটা ট্রেনের যাতায়াত  দেখেছি। মায়ের কথা জিগ্যেস করলে মামা গম্ভীর হয়ে যায়। মামি সোজাসুজি জানিয়ে দিল, মা টাকা না পাঠালে আমাকে যেন অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শুনি মামিকে ধমকাচ্ছে মামা’
-‘একটুও ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই কার্ডটা রাখুন। খুব তাড়াতাড়ি চলে যান। আমার কথা বলবেন। কিছু সুবিধা পেতে পারেন। ও হ্যাঁ। অবশ্যই সঙ্গে গার্জিয়ান নিয়ে যাবেন’  

  চেম্বার থেকে বেরিয়ে ছেলেটি হাঁটা শুরু করে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর একটি পার্কে গিয়ে উপস্থিত হলসিমেন্টের চেয়ারে আরাম করে বসল। নীল জিন্সের প্যান্টের উপর বাঁ হাতটি রাখা। বাঁ হাতের কব্জিতে চোখ চলে গেল। কব্জির কাছে সাদা মত দাগ। মামার দেওয়া ঘড়িটা কয়েকদিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আর পরে না। অবশ্য সারাই করতেও ইচ্ছা করছে না। আজকাল সেভাবে ঘড়ি পরার প্রয়োজনও হয় না। মায়ের কিনে দেওয়া ছোট্ট মোবাইলেই কাজ চলে যায়। কিন্তু দাগটা দেখে ওর অন্য একটি স্মৃতি জেগে উঠল। মাঝে মাঝেই ঘড়িটা কানের কাছে নিয়ে ও শব্দ শুনত। মৃদু ঝিক্‌ঝিক্‌ চোখ বুজে ও পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। কোন ঘড়ির শব্দ শুনতে পায় কিনা। কিন্তু না। ঐ তালিকায় ঘড়ির শব্দ নেই। শব্দগুলো এতই অদ্ভুত যে বাস্তবের কোন শব্দের সাথেই মেলানো যাচ্ছে না। ছেলেটি বিরক্ত আর অসহায় ভাবে সামনের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
 কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে বের করল ডাক্তারের দেওয়া কার্ডটি। ড. তাপস মুখার্‌জি। নিউরোলজিস্ট। ভাবছে এবার সে মামাকে নিয়ে যাবে। অনেকদিনের জমানো টাকা দিয়ে আজ ও ডাক্তার দেখাল। ভেবেছিল সামান্য ব্যাপার। অল্প কিছু অসুধ দিলেই রোগটা সেরে যাবে। কিন্তু এখন তো যেতে হবে আরেক ডাক্তারের কাছে। মা কবে আসবে ঠিক নেই। কতদিন আর এভাবে মামির বকাঝকা শুনতে হবে কে জানে! তাও আবার কানের সমস্যাটা জানানো হয় নিজানালে যে কী হবে! ভাবতেই ভয় করছে।  
  ডাক্তারের ব্যবহারে মিষ্টতা ছিল। বেশিরভাগ ডাক্তারই এমন হয়। শান্ত, ধীর স্থির। কিন্তু এই ডাক্তার ওকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করল। এটা বেশ ভালো লাগল। নিজেকে এই প্রথম দায়িত্ববান মনে হল।
 কবে যে ও রানাঘাট ফিরে যাবে! এখান থেকে প্রায় একশ কিমি দূরে। সরু চূর্‌ণী নদ বয়ে গেছে ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে। ছোট বেলায় কত বসে থেকেছে তার পাড়ে! চেষ্টা করেছে স্রোতের শব্দ শুনতে। কিন্তু না। চূর্‌ণীর জলে তেমন স্রোত নেই যে ও শব্দ শুনতে পাবে। কেবল তির তির মত একটা আভাস পেয়েছিল।

 কিছুক্ষণ পর ভাবনায় ছেদ পড়ে ছেলেটির। দূর থেকে দেখা যায় একটা চুড়িদার যেন হেঁটে আসছে। যত কাছে আসতে লাগল তত পরিষ্কার হল হাত, পা, কাঁধের ব্যাগ, মুখ। সে মুখ অবাক।
-‘আরে বাবাই! তুই এখানে? আজ পড়তে যাস নি কেন?’
-‘এমনি। ভালো লাগছিল নারীর খারাপ’কিছুটা বিরক্ত ভাবে ডাক্তারের কার্ডটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।
-‘বুঝেছি। শরীর খারাপ অথচ তুই পার্কে বসে আছিস! কেউ আসবে নাকি রে?’ হাসি ভাঁজ ফেলেছে মেয়েটির মুখমন্ডলে।
-‘আমার কে আছে যে আসবে! কিন্তু তুই এখানে কেন?’ বাবাই গম্ভীর।
-‘এমনি। ভাল্লাগছিল না। শরীর খারাপ’কপট হাসি।
-‘শরীর খারাপ হলে কেউ পার্কে আসে?’
-‘প্রশ্নটা নিজেকে করলি?’ বলে মেয়েটি গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদকে ওড়না দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করে।
 পিছন ফিরে তাকায়। কাকে যেন খুঁজছে বলে মনে হল।
 বাবাই বেঞ্চের ডান পাশে সরে গেল একটু। যদি ও বসে এসে, এই আকাঙ্ক্ষায়। তারপর উত্তর দেয়। -‘হুম্‌ বুদ্ধিমতী মেয়ে। এইচ এসে স্টার মার্কস তোকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। পল সায়েন্স স্যার সেদিন বলছিল স্বয়ং মার্ক্সও না’
-‘বাজে বকিস না। শরীর আরো খারাপ করবে!’ বলে মেয়েটি উত্তরের প্রতীক্ষা না করে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইয়ারফোনটা সেট করে বাবাইকে সাধে কানে লাগাতে।
-‘এই গানটা শোন্‌ আজি লোড করলাম। জাস্ট ফাটাফাটি। অবশ্যই চোখ বন্ধ করে শুনবি। নাহলে গান শুনে মজা নেই!’
বাবাই দ্বিধার সঙ্গে ইয়ারফোনটা হাতে নিল। অন্য মনস্ক ভাবে আস্তে করে জবাব দেয়।
-‘চোখ বন্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’
-‘কেন?’
-‘এমনি। ইচ্ছা করছে না’
  ততক্ষণে বাবাইয়ের চোখ দেখে চলেছে- চুড়িদারের কারুকাজ করা মেরুন রঙের হাতা থেকে হঠাত্‌ , বিনা ভূমিকায় নিচের দিকে নেমে গেছে একটা ফর্সা হাত। তারপর সেই ফর্সা ভাব আস্তে আস্তে পাঁচ আঙুলের তীক্ষ্ণ নখে ধারাল বিন্দু হয়ে শেষ হয়ে গেছে।
 চোখ বন্ধ করলে মাঝে মাঝে বাবাই এই রকম দৃশ্যেরই হয়ত সঙ্গীত সংস্করণ শুনতে পায়। নিশ্চয় ও এই ব্যাপারটা বোঝেনা। বোঝার কথাও নয়, এই বয়সে। কারণ চোখ বুজলেই শুধুমাত্র ও ঐ শব্দগুলো শুনতে পায়। কিন্তু দৃশ্যের সাথে, খোলা চোখের সাথে ওর শব্দগুলোর কি কোন সম্পর্ক নেই!
  ও কি পারবে এই রহস্যের সমাধান করতে! ঠিক যেমন তুলনার হঠাত্‌ এই পার্কে চলে আসা। এর কারণও তো ও জানে না। তার মানে তুলনা কি ওকে অনুসরণ করছিল! তা মনে হয়না। ও তো স্যারের ব্যাচে ছিল! এও তো হতে পারে ও আজ ব্যাচে যায় নি! কোথাও হয়ত অপেক্ষা করছিল বাবাইয়ের জন্য! এতোটা সম্ভব! একি বাস্তব! বাবাই তো মা-বাবা পরিত্যক্ত, মামা বাড়িতে পরে থাকা একটা জীবন্ত আবর্জনা! ওর জন্য কেউ এভাবে... ভালোলাগার পাশপাশি অবিশ্বাস বাবাইয়ের হৃদয়কে দ্বিখন্ডিত করে রেখেছে।  

  গান চলতে চলতে তুলনার মোবাইলে একটা ফোন আসে। ডিসপ্লের দিকে না তাকিয়েই বাবাই দ্রুত তুলনাকে দিল মোবাইলটা। ইয়ারফোনের একটা স্পিকার বাঁ কানে গুঁজতে গুঁজতে তুলনা একটু দূরে চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে দুটিমাত্র শব্দ রেখে যায় বাবাইয়ের জন্য। -‘আসছি রে!’ বলে পার্কের দুর্গম, প্রায় আপাত অপ্রবেশ্য গাছগুলোর জটিল ঘূর্ণির দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে তুলনা। আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায় চুড়িদার।  
  এই দৃশ্যও তো শব্দ হবে! কথা তো হবেই। কিন্তু কীভাবে! কোন রহস্যময় অনুবাদক বাবাইয়ের দৃশ্যগুলো এভাবে চমৎকার রূপান্তর করে দিচ্ছে! অনুবাদক যেমন অচেনা, তেমনই অজানা তার কার্যকলাপ। তাৎপর্যময় এই কার্‌য বাবাইয়ের কানে কলাপ হয়ে বিস্তার পাচ্ছে!  

  তারপর এক গভীর রাতে বাবাই তার পড়ার ঘরে। মামা মামি পাশের ঘরে ঘুমে অচেতন। কয়েকদিন অবিশ্রাম বৃষ্টির পর সূর্য তার সাত ঘোড়া নিয়েই অভিযানে নেমেছে। উত্তপ্ত একটা কড়াইয়ের মতই তাতিয়ে দিয়েছিল চারপাশকে। প্রচন্ড ঘামে নাজেহাল বাবাই। বারবার মুছছে গামছা দিয়ে। সামনে খোলা বই। কাল বাংলা স্যার পরীক্ষা নেবেন প্রাণপণে ঘুরছে সিলিং ফ্যানটা। ঘাম মোছা শরীরে একটা ঠান্ডা ভাব বাবাইকে মৃদু তন্দ্রাচ্ছন্ন করল।    
  হঠা লোডশেডিং। চারদিকে অপ্রস্তুত নীরবতা। ডান হাতের উপর মাথা রেখে বাবাই আধ শোয়া। ওভাবেই রইল। নড়ল না একটুকুও। চোখ বুজল। নিকশ কালো ভেদ করে বহু দূর থেকে ধীরে ধীরে , খুব মৃদু পায়ে আসছে সেই পরিচিত শব্দ বাহিনী। বাবাই মুগ্ধ। অবাক। অপার বিস্মিত। এমন ভাল তো কোনদিন লাগেনি! ছোট বেলায় বাবা-মায়ের মাঝখানে যখন শুয়ে থাকত গুটিশুটি হয়ে, তখনও না। মায়ের হাত যখন বুলিয়ে চলত পিঠ, তখনও না। বাবার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যখন আঁচরে দিত শরীর, তখনও না। ডাক্তারের মনোহর আলাপ। না। পার্কের বেঞ্চে একা একা বসে থাকা। না। তুলনার সেই অলৌকিক হাতের দৃশ্য। না। এমন ভালো কখনই লাগেনি বাবাইয়ের।

  খানিক্ষণ বাদে বাবাই অনুভব করল ওর চোখ খোলা। আর তখনও অন্ধকার ওর সামনে। আর তখনও কারেন্ট আসে নি। আর তখনও ওর কানে উড়ে চলেছে সেই অলৌকিক শব্দ পরীরা।








No comments:

Post a Comment