।। বাক্‌ ১১৮ ।। সনৎ মাইতি ।।




জ্যোৎস্নার আলোর মধ্যে দিয়ে, মাথার ওপর গাছের আলো ছায়ার মধ্যে দিয়েপাশ দিয়ে মাঝে মাঝে হুস হাস গাড়ির আলো ছুটে যাচ্ছে। ঢাল পেয়ে দুটো পা নিজে নিজেই থেমে যায়, আস্তে আস্তে গড়িয়ে যায় সাইকেল ...  আজ গড়ানোর শেষ বিন্দু পর্যন্ত যাব। তাকাই না কোন দিকে তাকাতে ভালো লাগে না মুখ নিচু কালো পিচ রাস্তার দিকে, চোখ দুটো আস্তে আস্তে বুজিয়ে নিই - চোখ খুলে দিই আমার ভেতরের ওই অন্ধকারের দিকে।  অন্ধকারের ভেতর লাল নীল খেলা চলে, খেলা দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাই... কালো পিচে রাস্তার আলো ছায়ায় গড়িয়ে যাই, গড়িয়ে যেতে হবে শেষ বিন্দু পর্যন্ত। সাইকেল মৃদু মৃদু আওয়াজ দিচ্ছে ক্যোচ... ক্যোচ...আওয়াজের ঠিক ঠাক অনুবাদ হল না হয়ত, আগে তো এত মন দিয়ে শুনিনি কোনদিন ওই আওয়াজ... বিছানা ডাকছে শুনতে পাচ্ছি, পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরতে চায়, বালিশ দুটো হয়ত জেগে বসে আছেএই মুহূর্তে আরেকটু অন্ধকার চাই, আর একটু বেশি অন্ধকার, আমার অন্ধকার কম পড়ছে। অন্ধকার লোভী আমি।
যত গড়াই তত পিছিয়ে পড়ি সময়ের থেকে, তবুও যেতে হবে কমতে কমতে শেষ বিন্দু পর্যন্ত। গড়াতে গড়াতে এসে থামি বিছানায়, বালিশে। বালিশ আমায় অন্ধকার ধার দেয়। কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন, আহা পরম অন্ধকার। ঈশ্বরের কোলের মত এই অন্ধকার। অন্ধকার আমাকে প্রথমে লাল নীল পুটকি পাঠায়, চোখ বুজে আরো ভালো করে দেখি, আরো মন দিয়ে দেখি


নভেম্বর শেষ হতে চলল , অথচ আজো ঘর আর গোছানো হল না। সেই কবে থেকে  (জানুযারীর নিউ ইয়ার) নিজেকে কথা দিয়ে রেখেছি। ঘর গোছাতে হবে’ ‘ঘর গোছানো টা তোমার একান্ত কর্তব্য’ ‘বাইরের একটা লোক যদি হঠাত এসে পড়ে কী ভাববেএত কিছু বলে নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছি কিন্তু কোথায় কী ! ... ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না আমিই টুনি, আমিই টুনির মা, আমিই টুনির প্রেমিক। একজনের মধ্যে তিনজন থাকলে যা হয় আরকী। প্রাচীন প্রবাদ অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টআমার ভেতর অধিক সন্ন্যাসী। তাই গাজনের বাম্বু।
মনের ভেতর তাগিদ আছে অথচ সালমান খনের সেই কিকটা পাচ্ছি না, তাই ল্যাদ আর কাটিয়ে ওঠা হচ্ছে না , বোম তার বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়েই শান্ত থাকে তবুও কাউকে না কাউকে তো সামান্য দেশলাই মারতেই হয় , ওই দেশলাই মারাটাই কিক। ওই দেশলাইটা পেলেই বাস্তিলের দুর্গের মুন্ডু থাকবে বর্শার ডগায়। এদিকে ঘর ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে , ঘরে আমি ছাড়া আরো অনেকের বাস - আমার সাপেক্ষে তাদের সবার অবস্থান গুলিয়ে যাচ্ছে।  সঠিক সময়ে বই পত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , মানি ব্যাগ মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক লুকিয়ে পড়ছে যখন আমার খুব দরকার তাকে। রুমাল খুঁজে পাচ্ছি না , জাঙ্গিয়া আমাকে অনেকক্ষণ ল্যাংটো করিয়ে রাখছে স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝে আরও কত কী অঘটন ঘটছে পুরো ঘরটা অ্যামাজনের বনসাই গোছের হয়ে গেছে, জিনিস পত্র আবিষ্কার করতে হয় কলম্বাসের দৃষ্টিতে। পরশু দিনই ওষুধের ব্যাগে খুচরো কুড়ি টাকা পেলাম প্রায় গুপ্তধনের মতো যখন সত্যিই কিছু খুচরো দরকার ছিলএই ঘরেই আমার অ্যাডভেঞ্চার । এই ঘরেই অ্যামাজন অভিযান। 

ল্যাপটপটা খুলতে হবে, রুটি খেতে খেতে বুঝতে পারছি অন্ধকার গুহার ভেতর তীব্র পিপাসার মধ্যে জলের সরু স্রোত চুইয়ে চুইয়ে আসছেনদীটাকে ধরতে হবে। ভেতরে ভেতরে... কল্পনা করছি লেখাটার, কীভাবে সাজাব লেখাটা, মনে মনে লিখতে আরম্ভ করে দিয়েছি... প্রথম লাইনটা পেয়ে গেছি... এবার খুব সাবধানে ধীরে ধীরে লেখাটা গড়িয়ে দিতে হবে ঢালে, ঢালে চলা সাইকেলের মত মন দিয়ে হ্যান্ডেল ধরে থাকতে হবে... মন দিয়ে ... মূল লেখাতে ঢোকার আগের লাইনে তারা দেব, এই ট্রিকটা প্রথম পেয়েছিলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পে। বোধহয় টোপগল্পে...

বাড়িতে ইতু পুজোর কোলাহল, পুকুরে জামাকাপড় ধোয়ার শব্দ, জলে তালগাছের ছায়ার সাপের লেজের মত নৃত্য, রাস্তায় সাইকেলের ক্রিং, কড়ায় খুন্তি নাড়ার শব্দ, পায়ের চটির শব্দ, মায়ের ডাক, মাইকে নচিকেতার গান সব পেরিয়ে নিজের ঘরের বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে হবে... যেখানে কালো মত ল্যাপটপটা রাখা আছে, দরজা জানলা বন্ধ করে দিতে হবে... তারপর ওই কালো ল্যাপটপটা কে দু হাত দিয়ে  চিরে ফেলতে হবে... যেমন ভাবে একটা কালো ঝিনুককে দুহাতে ভালো করে ধরে দুআঙুলে চিরে ভেতরের সাদা মুক্তটা বার করতে হয়, চিরে বার করতে হবে ল্যাপটপের ভেতরের সাদা ওয়ার্ড ফাইলটাকে,
ঘরের ছিটকিনিটা এঁটে দিলাম, জানালার কাঁচটা এঁটে দিলাম, ল্যাপটপের পাওয়ার বাটন মারলাম... সময় নিচ্ছে খুলতে...... ওয়ার্ড ফাইলের সাদা পাতার সামনে বাবু হয়ে বসব...সামান্য সময় চোখ বুজে থাকব... খুলে গেল... রিফ্রেস মারছি... F5…Desktop back Ground এ কী রাখা যায়? একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি? হুম তাই রাখ ... মাই কম্পিউটার > ডি ড্রাইভ > বিউটিফুলস... কাকে রাখব আজ প্রায় হাজার খানের জনের মধ্যে...... বিচার কর আজ এই মেঘলা দিনে কাকে বেশি সুন্দরী লাগছে... এমা ওয়াটসন ? না ভাল লাগছে না ওকে... তাহলে ইন্ডিয়ান কাউকে? ক্যাটরিনা কে? ওই সবুজ আম হাতে ধরা হলুদ ক্যাটরিনা কে ? ... না ব্রা পরে চোখ বুজিয়ে থাকা আদিতি রাও হায়দারি কেনা চোখ বুজিয়ে থাকা পাব্লিক চলবে না ... এমন কাউকে রাখ যার চোখ খোলা থাকবে ... যার চোখে চোখ রেখে হাসা যাবে... এই মেয়েটাকে দেখো... অল্প হাসছে । ক্লীভেজ দেখা যাচ্ছে... দুর্দান্ত সুন্দরী। কী নাম রে মেয়েটার?   মীরা চোপরাঠিক আছে একেই রাখ । অত জনের মধ্যে আজ একেই জিতিয়ে দে... আজ তুই প্রকৃতি। তোর হাতেই ন্যচারাল সিলেকসান । এই জার্নালটা হচ্ছে ডারউইন


*      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *

আমার দুহাত ছন্দহীন ছন্দে নাচছে, চোখ শিকারি কুত্তার ঠাণ্ডা মাথার মত স্থিরল্যাপটপের কালো কালো বাটনে আমার আঙুল নাচছে, আনন্দের নাচ না। পর্ণ ফিল্মে দেখা যােনিতে মধ্যমার নাড়ানোর মত মাপের নাচমাথার ভেতরের নাচ গুলো অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে, আঙ্গুলের নাচে, আঙ্গুলের নাচ কালো অক্ষরে খোদাই হয়ে যাচ্ছে মন্দিরে সিঁড়িতে উৎসর্গ সাদা পাথরের মত ওয়ার্ডের পাতায়, পাতার ভেতর কালো কালো অক্ষরে আঙ্গুলের নাচ দেখতে পাচ্ছেন তো হে পাঠক...

- কেন কেন এই বেঁচে থাকা...?
- কে জানে বাঁড়া কেন।
- তুমি শালা কবিতা চোদাও, কবিতার জন্য বেঁচে থাকা না ?
- না বাঁড়া আমি সুনীল গাঙ্গুলী না যে শুধু কবিতার জন্য এই বেঁচে থাকাকবিতা মূলত আমার গাঁড় মারে - চেন সিস্টেমে আমাকেও কবিতার গাঁড় মারতে হয়। কেউ আক্রমন করলে জবাব দেওয়াটা অবশ্য কর্তব্য...
- কোথায় আর গাঁড় মারলে? তোমার ভেতর অসুখের মত তো ঢুকে গেছে কবিতা... কবিতার গাঁড় মারতে হলে বেসিক্যালি নিজেরই গাঁড় মারতে হবে... নিজের পোঁদটা মারতে পারার  মত অত বড় বাঁড়া কি করতে পেরেছ ?

বাপ বাড়ি ফিরে কাঠি করে, মাকে বলে – ‘ মহারাজ কোথায় ? মহারাজ কে খেতে ডাকো
মহারাজ শুনতে পেয়ে বলল মহারাজ এখন দিবানিদ্রায় ব্যস্ত... উপযুক্ত সময়ে মহারাজ স্নানে যাবেন। (মহারাজের নিদ্রা ছুটে গেছে, মহারাজ এই প্রতিদিনের কাউন্টার অ্যাটাকে হাপিয়ে যাচ্ছে )

- কেন কেন এই বেঁচে থাকা?

মহারাজ পুরো রাজ্য আপনার উত্তরের অপেক্ষায় উত্তর দিন ।

উত্তর দিন, চুপ থাকবেন না কাইন্ডলি...

মহারাজ সবাই চেয়ে আছে আপনার দিকে

রাজার কেউ নেই... রাজা একা।
রাজা রাজাকে প্রশ্ন করে কেন? কেন এই বেঁচে থাকা
রাজা উত্তর দেয় রবিবারের মাংস ভাতের জন্য... খাসি না সাদা সাদা পালক ওয়ালা সস্তা, স্বাদহীন মুরগীর মাংসের জন্য... আপাত এছাড়া বেঁচে থাকার আর কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না ...

- আহা লজ্জা করো না। খাবার জন্যই বেঁচে থাকা... আকাশের ওই পাখি, রাস্তার ওই কুকুর গুলোকে দেখলেই বোঝা যায়। এই সরল সত্য অনেকেই মানতে পারে না। বাদ দাও... পেটে খিদে নিয়ে ন্যাকামো সাজে না


বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, বৃত্ত ক্রমশ বিন্দুর দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে, বৃত্ত থেকে বিন্দু। বিন্দু কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। যে কাঁটায় কম্পাস নেই। কোন দিক নির্দেশ নেই। চাকরি ছাড়তে ছাড়তে ছাড়া টুকুই অভ্যাস হয়ে গেল... ছোট বেলার চুল কাটার দোকান ছেড়ে দিলাম, সবাই কে ছেড়ে  ধীরে ধীরে নিজেকে একলা করে নিলাম। নিজেকে একলা করা শিখে নিলাম ।
দাড়ি রাখতে ভালো লাগে এখন । যত্নের দাড়ি না অযত্নের দাড়ি, এলোমেলো দাড়ি, ভাবে খোঁচা খোঁচা  রোঁয়া উঠে যাওয়া কুত্তার লোমের মত দাড়িদাড়ি কাটি না, খুব বড় না হলে চুল কাটি না তাতে সামান্য পয়সাও বেঁচে যায়ওই পয়সায় সামান্য ফুর্তি মারা যায়। কম দামি নেশা করা যায়।  সবচেয়ে বড় কথা এবং সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট ম্যাটার হল দাড়ি কে মুখোশ হিসাবে ব্যবহার করা যায়, লম্বা লম্বা মাথার চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি রেখে কি রে আজকাল কী করছিস?’  ‘ তা খবর কী এখন তোর’... এই ধরনের ক্যালানে চোদা নামক বলিয়ে কইয়ে মানুষ দের  কে প্রথম সাক্ষাতেই  ভড়কে দেওয়া যায়। পশুরা অনেক সময় শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য লোম খাড়া করে গা ফুলিয়ে নিজেকে বিশাল প্রমান করার চেষ্টা করে যাতে তাকে বিশাল ভেবে শত্রু পক্ষ ভয় পায়।  স্ট্র্যাটেজি খানিক ওরকমই । মুখোমুখি পড়ে গেলেই ওদের প্রথম অ্যাটেনশনটাই আমার দাড়ি গোঁফের আপাত গম্ভীর জঙ্গলের দিকে ঘুরিয়ে দিই।  আর একবার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফিরতে ফিরতে আমি তো পাখি। আর কে না জানে মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস তো উড়েই যায়। আমি তো সারসই হতে চেয়ে ছিলাম...
আমার মানুষ হওয়ায় আমার দায় নেই... আমার আপাত দেখতে মানুষ হবার জন্য দায়ী অন্য কেউ...

*            *            *            *            *            *            *

চাকরি এসেছে এক মালের সাথে দেখা করতে হবে। কাল বেলা এগারোটায় ইন্টারভিউ। বাপ খুশি হয়ে গেছে মা খুশি হয়ে গেছে । হঠাৎ বাড়িটা রঙিন হয়ে গেছে চাকরির খবরে।  এদিকে বাল আমি খুশি হতে হতেও হচ্চি না ,কারন এত সহজে খুশি হওয়া আমাকে  মানায় না। কতই তো এরকম দেখলাম, বোকারা এত সহজে খুশি হয় । কাল সক্কাল সক্কাল ছুটতে হবে।
কয়েকটা জিনিস জেরক্সের প্রয়োজনতড়িঘড়ি  কিছু জিনিস জেরক্স করাতে ছুটলাম। আর মনে মনে লিস্ট  করতে থাকলাম - একটা কালো পেন  নিতে হবে, কাজে লাগতে পারে।  কয়েকটা সাদা খাম, কালো জুতোটা বাক্স থেকে বার করে পরিষ্কার করতে হবে - কত দিন পড়ে আছে, একবার পালিশ করতে পারলে হত। পাসপোর্ট সাইজ ছবি গুলো কোথায় গেলমনে করতে পারছি না বাড়িতে গিয়ে খুঁজতে হবে হয়ত আর খান তিন চারেক পড়ে আছে। আর কিনতে হবে একটা ব্লেড।
কাজ গুছিয়ে রাখার জন্য এই মাঝ রাত্রে একা একা গালের জঙ্গল কাটছি ধারালো ব্লেডে... একটু একটু করে যেন আমার অযত্নের বর্ধিত মুখোশ আমি নিজেই ছিঁড়ে ফেলছি । মুখোশ হীন মাঞ্জা দিয়ে কাল দাঁড়াতে হবে অচেনা চোখের সামনে, দাড়ির আড়াল টুকু থাকবে না
এই মাঝ রাত্রে গালের জঙ্গল কাটতে কাটতে সেই কাঠুরিয়ার মতই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি যে গাছ ভালোবাসত





7 comments:

  1. ছবি ও লেখা , খুবই ভালো লাগল।এই একলা, কাঠুরিয়া কেই চেয়েছিলাম, বহুদিন।

    ReplyDelete
  2. ঘর গোছাতে হবে, বৃত্ত, ল্যাপটপ, চাকরি ভালো লেগেছে। ভালো কী লাগলো? আসলে এমন কিছু ব্যাপার হয়তো আছে। ভালো খারাপের বাইরেও কিছু কথা আছে। অভিনন্দন আপনাকে সনৎ।

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো লাগলো...♥

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো...♥

    ReplyDelete
  5. La-jobab lekha sanat! vitore giye dhakka dey. Keep it up...

    ReplyDelete